"লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ"


বন্ধ বইয়ের মত নিজেকে জানো না ! নয়তো জানতে তোমার মাঝে খোদার চিহ্ন লুকানো আছে। সত্য প্রকাশিত তোমার মাঝেই।
প্রচলিত ধর্মতত্ত্ব আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে চিন্তা করে। সেটাই হলো ধর্মতত্ত্বের মূল কথা, শরিয়ত আল্লাহ সম্পর্কে যুক্তি প্রদান করে, পর্যবেক্ষণ করে, চিন্তা করে, আল্লাহ সম্পর্কে ধারণা করে।
সুফিবাদ আল্লাহ সম্পর্কে চিন্তা করে না। কারণ সুফিগণ বলেন, তুমি কীভাবে আল্লাহ সম্পর্কে চিন্তা করতে সক্ষম? এখানে চিন্তাই অকেজো। তুমি এ দেহপৃথিবী সম্পর্কে চিন্তা করতে পার। কিন্তু আল্লাহ সম্পর্কে তুমি চিন্তা করতেই পার না।
তুমি কেবল তাঁর প্রেমে মশগুল হয়ে সম্পূর্ণরূপে তন্মধ্যে একাত্ম হয়ে যেতে পার। অতএব এটা কোনও ধর্মতত্ত্বই নয়, আত্মমুক্তির পথ পদ্ধতি শেষ। এটা তোমার সচেতন অনুশীলনমালার ফল। তরিকত সে পথ যে পথ মিলেছে পরমে পরম্পরায়।
যদি তুমি ফকিরকে অনুসরণ কর, যদি ধীরে ধীরে বিভেদ ভুলে অখণ্ড অস্তিত্বে বিলীন হও, তার শেষ ফল হলো, ফানা। ‘ফানা’ মানে হলো দেহলীন অবস্থা। বুদ্ধ (আঃ) যাকে বলেন ‘নির্বান’। তোমার সম্পূর্ণ বিলয় ঘটে কিন্তু তোমার বিলয়ে সেখানে আল্লাহর উদয় ঘটে।
যদি তুমি ফানার হালে থাক তবে হঠাৎ শূন্য থেকে তোমার ভেতর আর একটা হালের উদ্বোধন হয়, তাকে বলে বাকা। ‘বাকা’ হলো চিরসত্তাবান। সুফিবাদ হলো ফানা এবং বাকার মধ্যে একটা সাঁকোস্বরূপ। প্রথমে তোমার অহমের বিলয় ঘটাতে হবে ফানা ফিল্লায়, তাহলেই তোমার মাঝে আল্লাহর আসন তৈরি হবে বাকা বিল্লায়।
শিশিরবিন্দুকে শিশিরবিন্দু হিসেবেই মহাসমুদ্রে বিলীন হতে হবে, এমনই ফানার করণ। কিন্তু যে মূহুর্তে শিশিরবিন্দু মহাসমুদ্রে পতিত হয় তৎক্ষণাৎ সেও পরিণত হয় মহাসাগরে, একেই বলে বাকা। নিজের ক্ষুদ্রসত্তাকে বিলীন করাই প্রকৃত সত্তাবান হওয়ার উপায় এবং বিলীন হবার সবচেয়ে ভালপদ্ধতি হলো প্রেমভক্তিযোগ।
সে কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রেমভক্তি বা প্রেমোপাসনায় নারাজ। যদি তুমি অহমকে প্রশ্রয় দাও তবে তোমাকে প্রেমহীন থাকতে হবে। প্রেম ও অহম একসাথে চলতে পারে না। জ্ঞান এবং অহম যথারীতি একসাথে চলতে পারে।
কিন্তু প্রেম আর অহম একত্রে থাকতেই পারে না, আদো পারে নাই। তারা একে অপরকে সঙ্গ দিতে পারে না। তারা আলো এবং আঁধারের মত। যদি আলো আসে তবে আঁধার থাকতে পারে না। আঁধার কেবল তখনই থাকতে পারে যখন আলো থাকে না।
যদি প্রেম না থাকে তবে সেখানে অহম থাকতে পারে; প্রেম থাকলে অহমিকা আর থাকতেই পারে না। অন্যদিকে, যদি অহমিকার অবসান ঘটে তাহলে সবদিক থেকে প্রেমের উদয় হয়। তখন সহজিয়াভাব সবদিক থেকে তোমাকে কানায় কানায় ভরিয়ে তোলে আনন্দে।
প্রকৃতি যেমন শূন্যস্থান ভরিয়ে তোলে আল্লাহও তেমনই সতত শূন্যতা পূরণ করেন। তুমি শূন্য হবে এবং আল্লাহ ত্বরিৎ তোমায় ভরিয়ে তুলবেন বিচিত্র বিভায়।
প্রথম বিষয় হলো ফকির এবং দ্বিতীয় বিষয় হলো জিকির। ফকির মানে তৃণের মত দীনহীন, অহমশূন্যতা, সরলতা ও আমিত্ববাচক ধারণার বিলয়। এবং ‘জিকির’ মানে হলো সংযোগ। ব্যক্তিক আমিত্বের অন্তর্ধান, কেবল প্রত্যক্ষতা, সেই প্রত্যক্ষণের মাঝে কেবল মোর্শেদরূপ আল্লাহর স্মরণ-সংযোগ, সেই সংযোগে তোমার মাঝে অনুরণনিত হতে দাও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’।
তোমার শূন্যতাকে সেই সংযোগে সংযুক্ত হতে দাও। তোমার সে সত্তাহীন শুদ্ধতার মাঝে কেবল একটা সঙ্গীতই শোন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তার সঙ্গে আন্দোলিত হও, নাচো, ঘুরপাক খাও এবং সঙ্গীতসুধায় তোমার অন্তর কলসিকে কানায় কানায় ভরে উঠতে দাও।
তোমার শরীরের প্রতিটি কোষ বারবার বলতে থাকবে, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ …”
খোদার ঘরে খোদ মানুষ এমন অবহেলিত থাকতে পারে না । সুফি উক্তি।
যদি সবখানেই কেবল আল্লাহই অস্তিত্বমান তবে মনসুর হাল্লাজ যা ঘোষণা দিয়েছেন সেটাই তো সঠিক, “আনা আল হক” অর্থাৎ আমি মূর্ত বাস্তব, আমিই সত্য।
তাহলে উপনিষদের আদি ঋষিই তখন সত্য যখন তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দেন “অহম ব্রহ্মর্ষী” তথা আমিই পরমসত্ত্ব। বুদ্ধ (আঃ) যথার্থই বলেন যখন তিনি জানান দেন, “কেবল আমিই আলোকিত হইনি, যে মূহুর্তে আমি আলোয় আলোয় ভরে উঠলাম তখন আমি সমস্ত অস্তিত্বকেও আলোকিত হয়ে উঠতে দেখলাম।
আমি ঘোষণা করছি, আমার মতই সমগ্র অস্তিত্বও আলোকিত হয়ে উঠছে! তুমি তা অবহিত নাও হতে পার। কিন্তু আমি তোমার অন্তর্গত আলোটুকু দেখতে পাই”।
অবশ্য একজন সত্যিকারের গুরুর কাজ হলো, শিষ্যের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে দেখা। যে কোনও মূহুর্তে সে কী হয়ে উঠতে পারে, এবং সত্যিকারভাবে সেটাকে ঘটিয়ে তুলতে সাহায্য করা।
"তোমরা আসলে ছদ্মবেশে সবাই আল্লাহ"
আমি তোমাদের আল্লাহ সম্বন্ধে কোনও শিক্ষা দিচ্ছি না। আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান দেবার কোনও আগ্রহই নেই আমার। আমি আমার আল্লাহসত্তাকে তোমাদের সাথে ভাগ করছি, এটা একটা ভাগাভাগি।
আমি তোমার ভেতরের ঘুমন্ত আল্লাহকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করছি, উদ্দীপ্ত করতে চাইছি। এবং এতকাল ধরে সুফিগণ তাইই করে এসেছেন সত্য-সুপথের
সম্ভাবনাকে উদ্দীপিত করে।
এ তো কাবা নয়
সে তো নির্বোধের তোয়াফযোগ্য
এ কোনও মসজিদও নয়
সেখানে তো অসভ্যের চিৎকার।
এ হলো সর্বনেশে দেবপীঠ।
এখানে ঐহিক মাতাল
পরকালের আগে নিজেরা হাসর করে….!
আমিও এ সভা সম্পর্কে একই কথা বলতে চাই, “এ তো কাবা নয় সে তো নির্বোধের তোয়াফের জন্য” সে জন্য নির্বোধেরা আমার উপর দারুণ ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ। এটা ইটপাথরের মসজিদও নয়, সেখানে তো অসভ্যেরা গর্দভের মত চেচাঁয়”। এটা হৈ হুল্লোড় করার বা ভিড় জমানোর কোনও জায়গা নয়।
এটা কেবল নির্বাচিতদের জন্য, কেবল তাদের জন্য যারা তাঁদের প্রেমে ডুবে মরতে প্রস্তুত। এ শুধুই তাদের জন্য যারা আল্লাহকে খুঁজে পারার জন্য কঠিন সঙ্কল্পবদ্ধ এবং সমস্ত ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। এ তো সর্বনেশে দেবপীঠ ‘খারাবাত’। যদি তুমি আমার ঘনিষ্ঠ হও তবে মনে রেখ, তুমি মরতে যাচ্ছ নিশ্চিত।
মোহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, “মরার আগে মর”। সেটা একটা সুফিকথা “মরার আগে মর”। মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে, মৃত্যু তোমায় নিয়ে যাবে, কিন্তু সেটা স্বেচ্ছামৃত্যু নয়, সমর্পণ নয়। তোমাকে মরতে বাধ্য করা হবে।
একজন সুফি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন; তিনি নিগূঢ় প্রেমে ডুবে মরেন। সেখানে তিনি প্রাকৃতিক মৃত্যুর অপেক্ষায় আর থাকেন না, প্রেমই তাঁর মরণের আগে মরে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। এবং প্রেমে ডুবে মরা চমৎকার। কারণ প্রেমে ডুবে মরা মানেই মৃত্যুকে ছাপিয়ে অমর হয়ে যাওয়া।
তাই মোহাম্মদের (সাঃ) অমৃতকথা শোন : “মরার আগে জ্যান্তে মর”। এখন যদি তোমরা এখানে আমার সাথে মরতে পার। আমি একজন মৃত মানুষ। আমি মরেছি। এবং আমি তোমাদের যা কিছু শেখাচ্ছি সেটা মরণকৌশল যাতে তোমরা ফানার হালে পৌছাতে চাও, অমর হয়ে উঠতে পার।
যদি তোমরা সম্পূর্ণ বিলীন হতে পার তবে তৎক্ষণাৎ আল্লাহ তোমায় বাকাতে পুরস্কৃত করবেন, তোমার চিত্তে তাঁর অধিষ্ঠান হবে এবং তিনি মহান সেই সত্তা চিরন্তনী।
তোমাকে প্রথম যে দরজাটি পার হতেই হবে সেটা প্রেমের দরজা। কারণ কেবল একজন শুদ্ধচিত্ত প্রেমিকই স্বেচ্ছামৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকেন। আর কেউই স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণের সাহস পায় না। কেবল একজন প্রেমিকই তা পারেন।
কারণ প্রেমিকই জানেন, এ মরা মরণ নয় বরং অমৃত আস্বাদন এবং চিরন্তন পথচলা।
আল্লাহ ইতোমধ্যে তোমার অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ হয়েই আছেন! কিন্তু তুমি সে প্রেমসাগরে ডুবে মরার জন্য যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করতে পারনি। সুফিগুরু তোমাকে প্রেমের মরা হতে প্ররোচিত ও উদ্বুদ্ধ করবেন।
একজন সুফি মরমী বলেনঃ
আমি তোমাকে এতই ভাবতাম যে আমি সম্পূর্ণ তোমাতে পরিণত হলাম তোমার মতন।
ধীরে ধীরে তুমি আমায় টেনে নিলে তুমি এবং মরার আগে ঘটল আমার মহান মরণ ॥
যদি তুমি আল্লাহকে স্মরণ কর…এবং আল্লাহকে স্মরণ করা মানে গাছপালা, পশুপাখি, লোকজন, জীবজন্তু সব কিছুতেই তাঁকে দেখতে পাওয়া। যেখানে জীবন সেখানেই আল্লাহকে দেখ, যেখানে অস্তিত্ব সেখানেই আল্লাহকে খোঁজ। কারণ কেবল তিনিই আছেন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’।
সুতরাং তাঁকে যে কোনও স্থানে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। তাঁকে সর্বত্র দর্শন করা যেতে পারে। আল্লাহকে ব্যক্তিমানুষ হিসেবে কখনও খুঁজো না, তাহলে তাঁর নাগালই পাবে না।
সে কারণেই হাজার হাজার মানুষ আল্লাহর খোঁজ করে। কিন্তু তাঁর নাগাল পায় ক’জন? তারা একটা নিশ্চিত প্রতিকৃতি মনে নিয়ে তাঁর খোঁজে বেরোয়। আল্লাহর কোনও প্রতিকৃতি নেই; আল্লাহ কোনও ব্যক্তি নন।
আল্লাহ হলেন অখ-তা ও মহাসমগ্রতা। তাই কোনও নির্দিষ্ট খণ্ডিত ব্যক্তি বিশেষকে খুঁজতে শুরু করো না। হয় তো তুমি কোনোদিনই তাঁকে খুঁজে পাবে না। এমনও হতে পারে, তাঁকে খুঁজে না পেয়ে তুমি একদিন ভাবতে শুরু করলে, কোনও আল্লাহই নেই।
তুমি একটা ভুল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যাত্রা করেছিলে। কারণ ঈশ্বরকে ব্যক্তির খণ্ডত্বে ভাবা হয়েছে। পৃথিবীতে অসংখ্য নিরীশ্বরবাদী রয়েছে। তোমাদের মত তথাকথিত ধার্মিকদের জন্যই আজ পৃথিবীতে এত লোক নিরীশ্বরবাদী হয়ে পড়েছে।
এসব তথাকথিত ধার্মিক লোকেরা ঈশ্বর সম্পর্কে এমনভাবে কথা বলে যেন তিনি একজন সামান্য ব্যক্তিমাত্র। এবং তারপর তারা সেটাকে প্রমাণই করতে পারে না। তারা স্বাভাবিকভাবেই এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করে যাতে নাস্তিকতা বিস্তারলাভ করে।
ঈশ্বর মোটেও খণ্ডিত কোনও ব্যক্তি নন। ঈশ্বর এমনই নৈর্ব্যক্তিক অস্তিত্ব যাঁর উপর ব্যক্তিকতা আরোপ করলেই হয়ে যায় শেরেক। একথাটি সব সময় তোমরা মনে রেখ, সুফিবাদ অস্তিত্বের সমার্থক ও বাস্তবতার সমর্থক। অস্তিত্বের চিরবিদ্যমানতাই ঈশ্বরসত্তা। তাহলে বিষয়টা বুঝে ওঠা তোমাদের কাছে সহজতর হয়ে যাবে। """ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ """"
ওশো...

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বিদেশে উচ্চ শিক্ষা !

ফিলিপাইন ভ্রমন

আমার ভাবনায় বন্ধুত্ব

"জন্মাই আমার আজন্ম পাপ/অভিশাপ"

কর্মজীবীদের চাকরী নিয়ে বিদেশ যেতে করনীয়।

জীবনের জটিলতায় আজ ভবঘুরে আমি !

ধ্রুবতারার প্রেম

মানব মগজ

স্বর্গের মত একটা গ্রাম, রাইন-নরওয়ে